বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন

ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ

  • বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর বর্মরক্ষক ‘ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী, ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের।
  • সোনারগাঁওয়ের বাইরে লখনৌতির শাসনকেন্দ্রে তখন দিল্লির শাসনকর্তাগণ শাসন করতেন। তাঁরা ফখরুদ্দিনেরী স্বাধীনতা ঘোষণাকে সুনজরে দেখেননি। তাই লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন মিলিতভাবে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি। কদর খান ফখরুদ্দিনের সৈন্যদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
  • একজন স্বাধীন সুলতান হিসাবে ফখরুদ্দিন নিজ নামে মুদ্রা জারি করেছিলেন।
  • তাঁর মুদ্রায় খোদিত তারিখ দেখে ধারণা করা যায়, তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সোনারগাঁও রাজত্ব করেন।
  • তিনিই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন।

ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ

  • ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে মুবারক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গাজী শাহ সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে বসেন।
  • ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও টাকশাল থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ নামাঙ্কিত মুদ্রা জারি করা হয়।
  • ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে গাজি শাহ পশ্চিম বঙ্গের লখনৌতির সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের নিকট পরাজিত ও নিহত হন।

আলী মুবারক

  • সোনারগাঁওয়ে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যখন স্বাধীন সুলতান তখন লখনৌতির সিংহাসন দখন করেছিলেন সেখানকার সেনাপতি আলী মুবারক।
  • সিংহাসনে বসে তিনি ‘আলাউদ্দিন আলী শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন।
  • লখনৌতিতে তিনি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন পান্ডুয়ায় (ফিরোজাবাদ)।
  • আলী শাহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
  • ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং নিহত হন।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ

  • শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথম জীবনে দিল্লির সালতানাতের অধীনে চাকরি করতেন এবং পরবর্তীকালে বাংলায় সাতগাঁওয়ের দিল্লির প্রাদেশিক গভর্নর ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে কাজ করা শুরু করেন।
  • ১৩৩৮ সালে ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যু হলে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁওয়ের ক্ষমতা দখল করেন এবং একে দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন।
  • ১৩৪২ সালে প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে লখনৈতির সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহকে পরাজিত করে তিনি লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন।
  • ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে বিতাড়িত করে সোনারগাঁও অধিকার করেন।
  • সোনারগাঁও দখলের মাধ্যমে সমগ্র বাংলার অধিকার সম্পন্ন হয়। তাই বলা হয়, ১৩৩৮ খিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে।
  • বাংলার বাইরেও বিহারের কিছু অংশ- চম্পারণ, গোরক্ষপুর এবং কাশী ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন। কামরূপের কিছু অংশও তিনি জয় করেন। এরূপে তার রাজ্যসীমা আসাম হতে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
  • ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে রাজধানী কাঠমুন্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি নেপালের কোনো অংশ তার রাজ্যভুক্ত করেন নি।
  • সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য “একডালা দুর্গে” আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে বর্ষা এলে জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ফিরোজ শাহ সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে ইলিয়াস শাহের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিল্লি ফিরে যান।
  • হাজিপুর নামক একটি শহর তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
  • ফিরুজাবাদের বিরাট হাম্বামখানা তিনিই নির্মাণ করেন।
  • ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই বাঙ্গালা’ ও ‘শাহ-ই-বাঙালি’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • তিনি ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ অথবা ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯০ খ্রিঃ)

  • শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  • তাঁর রাজত্বাকালে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৮ থেকে ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন।
  • পিতার মতো সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।
  • সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জাফর খানকে সোনারগাঁওয়ের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু জাফর খান এ পদ গ্রহণে রাজি হলেন না। ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তিনিও দিল্লিতে ফিরে গেলেন। সোনারগাঁও এবং লখনৌতিতে আবার আগের মতোই সিকান্দার শাহের কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রইল।
  • তাঁর উদ্যোগে বহু মসজিদ, মিনার ও প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। পান্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্প কীর্তি।
  • ১৩৯০ সালে রাজধানী পান্ডুয়ার কাছে গোয়ালপাড়ার যুদ্ধে তিনি তার পুত্রের কাছে পরাজিত ও নিহত হন।

গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১ খ্রি:)

  • সুলতান সিকান্দার শাহকে হত্যা করে তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন ‘আজম শাহ’উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  • জৌনপুরের রাজা খান জাহানের সহিত তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
  • চীনা সম্রাট ইয়াংলো তাঁর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন।
  • তাঁর রাজত্বাকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্‌ মুহম্মদ সগীর ‘ইউছুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন।
  • আজম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সুফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন।
  • ১৪১১ সালে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মৃত্যুবরণ করেন।

সাইফুদ্দিন হামজা শাহ (১৪১১-১৪১২ খ্রি:)

  • গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসেন।
  • শিহাবউদ্দিন সুলতান হয়ে সুলতানুস সালাতিন উপাধি ধারণ করেন।
  • হামজা শাহর রাজত্বকালে বাংলায় গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। এ সময় অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।
  • তিনি ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিনের হাতে নিহত হন।

শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ (১৪১২-১৪১৪ খ্রি:)

  • ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে সাইফুদ্দিন হামজা শাহকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন।
  • তিনি ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বর্ণ করেন ( মতান্তরে রাজা গণেশ হত্যা করেন) ।

প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ

  • প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন সুলতান শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহর পুত্র ও উত্তরসুরি।
  • সুলতান হলেও, দিনাজপুরের জমিদার রাজা গণেশ এসময় মূল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
  • কয়েকমাস শাসন করার পর গণেশ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
  • ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি রাজধানী ত্যাগ করে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রচেষ্টা করলে গণেশ তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।

রাজা গণেশ ও হাবসী শাসন

  • সুলতান প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজা গণেশ মসনদে বসেন।
  • তিনি “দনুজমর্দনদেব” উপাধি নিয়েছিলেন।
  • আজম শাহের একজন উচ্চপদস্থ অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ।
  • গণেশ প্রথমে দিনাজপুরের ভাতুরিয়া অঞ্চলের একজন রাজা ছিলেন।
  • গণেশ অনেক সুফী সাধককে হত্যা করেন।
  • মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য দরবেশদের নেতা নূর কুতুব-উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির নিকট আবেদন জানান।
  • ইব্রাহিম শর্কি সসৈন্যে বাংলায় উপস্থিত হলে গণেশ ভয় পেয়ে নূর কুতুব আলমের কাছে আত্মসমর্পণ এবং তাঁর ছেলে যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ছেলের হাতে বাংলার সিংহাসন ছেড়ে দেন।
  • মুসলমান হওয়ার পর যদুর নাম হয় জালালউদ্দিন মাহমুদ। সুলতান ইব্রাহিম শর্কি জামালউদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ জৌনপুরে।
  • ইব্রাহিম শর্কি ফিরে গেলে গণেশ জালালউদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
  • অনেক আচার-অনুষ্ঠান করিয়ে ছেলেকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন।
  • তাঁর দুটি স্থাপত্য সৃষ্টি হলো গৌড়ে ”ফতে খাঁর সমাধি ভবন ” এবং পান্ডুয়ার ”একলাখী প্রাসাদ”।
  • গণেশ ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
  • রাজা গণেশের মৃত্যুর পর হিন্দু আমাত্যগণ গণেশের পুত্র মহেন্দ্রদেবকে বঙ্গে সিংহাসনে বসান।
  • কিন্তু অতি অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে জালালউদ্দিন দ্বিতীয়বার বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ

  • তাঁর প্রকৃত শাসন শুরু হয় ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশ ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রের চূড়ান্ত উৎখাতের পর।
  • প্রায় সমগ্র বাংলা এবং আরাকান ব্যতীত ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  • তিনি ফতেহাবাদ (ফরিদপুর) জয় করে দক্ষিণবঙ্গে রাজ্য সম্প্রসারণ করেন।
  • পান্ডুয়া হতে তিনি গৌড়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
  • তিনি ‘সুলতান’ ও আমীর উভয় উপাধি ব্যবহার করেন এবং আববাসীয় খলিফার নিকট থেকে সম্মানসূচক পোশাক খিলাত ও খেতাব লাভ করেন।
  • জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  • ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে আহমদ শাহ আমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রে সাদি খান ও নাসির খান নামক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন।
  • এভাবে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের প্রায় ত্রিশ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে।
  • পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন

    • শামসুদ্দিন আহমদ শাহের মৃত্যুর পর তার হত্যাকারী ক্রীতদাস নাসির খান বাংলার সিংহাসনে বসেন।
    • কিন্তু আহমদ শাহকে হত্যা করার ব্যাপারে যে সকল অভিজাতবর্গ নাসির খানকে ইন্ধন দেন তারা নাসির খানের সিংহাসনে আরোহণকে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারলেন না। তাই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাসির খানকে হত্যা করেন।
    • নাসির খান নিহত হওয়ার পর গৌড়ের সিংহাসন কিছু সময়ের জন্য শূন্য অবস্থায় পড়ে রইল। আহমদ শাহের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। অতপর অভিজাতবর্গ মাহমুদ নামে ইলিয়াস শাহের এক বংশধরকে বাংলার সিংহাসনে বসান। ইতিহাসে তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে পরিচিত।

    নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ

    • ক্ষমতাগ্রহণের পর তিনি নাসিরুদ্দিন আবুল মুজাফ্ফর মাহমুদ শাহ উপাধি গ্রহণ করেন।
    • যশোর ও খুলনা অঞ্চল নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে মুসলমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
    • পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও বিহারের কতকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি নিজ নামে মুদ্রাও জারি করেছিলেন।
    • ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন।

    রুকনউদ্দিন বরবক শাহ

    • এরপর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।
    • পিতার রাজত্বকাল তিনি ছিলেন সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা।
    • গঙ্গা নদীর উত্তরাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
    • ভাগলপুর তাঁর শাসনকালে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
    • বরবক শাহই প্রথম অসংখ্য আবিসিনীয় ক্রীতদাস (হাবসী ক্রীতদাস) সংগ্রহ করে সেনাবাহিনী ও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন।
    • পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি “অল – ফাজিল” ও “অল – কামিল” উপাধি তে ভূষিত হন।
    • বৃহস্পতি মিশ্র ছিলেন গীতগোবিন্দটীকা, কুমারসম্ভবটীকা, রঘুবংশটীকা প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক।
    • বিখ্যাত বাংলা কাব্য “শ্রীকৃষ্ণবিজয়” এর রচয়িতা মালাধর বসু কে তিনি “গুনরাজ খাঁ” উপাধি প্রদান করেন।
    • বাংলা রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাস বরবক শাহের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন।
    • এ সময়ের মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে “শরফনামা ” নামক শব্দকোষ এর রচয়িতা ইব্রাহিম কাইয়ুম ফারুকী, আমীর জয়েনউদ্দীন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী ও মনসুর শিরাজীর নাম বিশেষভাবে উলে- যোগ্য।
    • গৌড়ের ‘দাখিল দরওয়াজা’ নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তোরণটি বরবক শাহ্‌ই নির্মাণ করেছিলেন। এ আমলে চট্টগ্রামে এবং পটুয়াখালী জেলার মীর্জাগঞ্জে দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
    • ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন।

    সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ (১৪৭৪- ১৪৮১ খ্রিঃ)

    • বরবক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ বাংলার সুলতান হন।
    • তাঁর রাজ্য পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং পূর্বে সিলেট পর্যন্ত ছিল।
    • তার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি জয়নুদ্দিন তার রাসুল বিজয় গ্রন্থ সম্পন্ন করেন।
    • তার শাসনামলে মালদার সাকোমোহন মসজিদ, তান্তিপারা মসজিদ, কদম রসুল মসজিদ ও গৌড়ের দরাসবারি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
    • ১৪৮১ সালে শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ মৃত্যুবরণ করেন।

    জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ(১৪৮১-১৪৮৭ খ্রিঃ)

    • ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে অপসারণ করা হয়। বরবক শাহের ছোট ভাই হুসাইন ‘জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন ।
    • হাবসী ক্রীতদাসরা এ সময় খুব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। এদের প্রতাপ কমানোর জন্য জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ চেষ্টা করেন। এতে সমস্ত হাবসী ক্রীতদাস একজোট হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
    • সুলতান শাহজাদা ছিলেন প্রাসাদ রক্ষীদলের প্রধান। ক্রীতদাসগণ প্রলোভন দ্বারা সুলতান শাহজাদা ও তার অধীনস্থ পাইকদের নিজ দলভুক্ত করে। শাহজাদা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে ফতেহ শাহ্‌কে হত্যা করে।
    • ফতেহ শাহ নিহত হলে বাংলার সিংহাসনে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলায় হাবশিদের রাজত্বের সূচনা হয়।
    • শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয় তাঁর সময়েই ।

    হাবসী শাসন(১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিঃ)

    • হাবসী নেতা সুলতান শাহজাদা ‘বরবক শাহ’ উপাধি নিয়ে প্রথম বাংলার ক্ষমতায় বসেন।
    • কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হাবসী সেনাপতি মালিক আন্দিলের হাতে নিহত হন।
    • মালিক আন্দিল ‘সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।
    • তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় নাসিরউদ্দিন শাহমুদ শাহ।
    • কিন্তু কিছুকাল (১৪৯০-১৪৯১ খ্রিঃ) রাজত্ব করার পরই তিনি নিহত হন। এক হাবসী সর্দার তাঁকে হত্যা করে ‘শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৪৯১-১৪৯৩ খ্রি:)।
    • গৌড়ের সম্ভ্রান্ত লোকেরা মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেন মুজাফফর শাহের উজির সৈয়দ হোসেন। অবশেষে মুজাফফর শাহ নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় হাবশি শাসনের অবসান ঘটে।
    • এই শাসনকাল কে পণ্ডিত রা অন্ধকার যুগ বা Dark Age বলে বর্ণনা করেছেন।

    হোসেন শাহী বংশ(১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি:)

    • হাবসী শাসন উচ্ছেদ করে বাংলায় ‘হুসেন শাহী বংশ’ নামে এক নতুন বংশের শাসনপর্ব শুরু করেন সৈয়দ হোসেন।
    • এভাবেই বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে হুসেনশাহী আমল ছিল সবচেয়ে গৌরবময় যুগ।

    সৈয়দ হোসেন

    • সুলতান হয়ে তিনি ‘আলাউদ্দিন হুসেন শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন।
    • তার শাসনামল কে বাংলার স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়।
    • বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই পান্ডুয়া বা গৌড় ব্যতীত অন্যত্র রাজধানী স্থাপন করেন।
    • তিনি কামরূপ ও কামতা জয় করেন। ঊড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশও তাঁর করায়ত্ত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ বিহারের কিছু অংশও তাঁর অধিকারে আসে।
    • তিনি আরাকানীদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করেন।
    • এ সময়ে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদী বাংলা আক্রমণ করলে তিনি তা প্রতিহত করেন।
    • একমাত্র আসাম অভিযানে তিনি সফল হতে পারেননি।
    • সুলতান ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
    • ওয়ালি মুহাম্মদ গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ নির্মাণ করেন।
    • তাঁর শাসনকালেই আবির্ভাব ঘটে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যের। হুসেন শাহ তাঁর প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন ।
    • সত্যপীরের আরাধনা হুসেন শাহের শাসনকালের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সত্যপীরের আরাধনা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল প্রচেষ্টা।
    • এ যুগের প্রখ্যাত কবি ও লেখকদের মধ্যে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, মালাধর বসু, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস, পরাগল খান ও যশোরাজ খান উল্লেখযোগ্য ছিলেন। সনাতনের উপাধি ছিল “সাকর মল্লিক” বা ছোট রাজা।
    • রূপ গোস্বামী “বিদগ্ধ মাধব” ও “ললিত মাধব ” নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
    • এ সময়ে মালাধর বসু ‘শ্রীমদ্ভাগবৎ’ ও ‘পুরাণ’এবং বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল রচনা করেন।
    • হোসেন শাহের অধীন চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর তার পাণ্ডববিজয় বা পরাগলী মহাভারত রচনা করেন।
    • পরাগল খানের উত্তরাধিকারী হিসেবে চট্টগ্রামের গভর্নর হওয়া তার পুত্র ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের আরেকটি সংস্করণ বাংলায় রচনা করেন।

    নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ(১৫১৯- ১৫৩২ খ্রিঃ)

    • আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নুসরত শাহ ‘নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফফর নুরসত শাহ’উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন।
    • এ সময় সমগ্র বিহার তাঁর অধীনে আসে।
    • তাঁর সময়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বাংলা অভিযানের জন্য সৈন্য পাঠান।
    • নুসরত শাহ প্রথমে বাবরের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। পরে যুদ্ধ শুরু হলে সন্ধি করে বাংলার সিংহাসনকে নিরাপদ রাখেন। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে নুসরত শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।
    • বাগেরহাটের ‘মিঠা পুকুর’ আজও তার কীর্তি ঘোষণা করছে।
    • গৌড়ের বিখ্যাত ‘কদম রসুল’ ভবনের প্রকোষ্ঠে তিনি একটি মঞ্চ নির্মাণ করেন। তাঁর উপর হযরত মুহম্মদের (দঃ) পদচিহ্ন সম্বলিত একটি কালো কারুকার্য খচিত মর্মর বেদি বসানো হয়।
    • গৌড়ের সুবিখ্যাত ‘বড় সোনা মসজিদ’ বা ‘বারদুয়ারী মসজিদ’ তাঁর আমলের কীর্তি।

    দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহ

    • বাংলার পরবর্তী সুলতান ছিলেন নুসরত শাহের পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহ।
    • তার শাসনামলে আসামের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়।
    • ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ফিরোজ শাহকে হত্যা করেন।
    • তাঁর আমলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো শ্রীধর কবিরাজ নামে জনৈক কবি “কলিকামঙ্গল” বা বিদ্যা সুন্দর কাব্য রচনা করেন।

    গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ

    • গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ফিরোজ শাহকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
    • তিনি ছিলেন হোসেন শাহি রাজবংশের সর্বশেষ সুলতান।
    • তার শাসনামলে ১৫৩৪ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম আসে।
    • ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের শাহ গৌড় দখল করলে বাংলার দুইশত বছরের স্বাধীন সুলতানী যুগের অবসান ঘটে।